কলতান

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এবং নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের প্রশ্নসমূহ

বাংলাদেশের মানুষের জন্য চরম নিরাপত্তাহীনতা, নিপীড়ন এবং হয়রানির কুখ্যাত অস্ত্র ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’। সাধারণভাবে কোনো আইনের তোয়াক্কা না করে কোনো কারণ না দেখিয়ে বিভিন্নজনকে তুলে নেওয়া, গোপন জায়গায় আটকে রাখা, ক্রসফায়ার, গুম, হেফাজতে নির্যাতন খুন সবই চলছে। সমাজে ভয়ের রাজত্ব সৃষ্টি করতে, ভিন্নমত দমন করতে এবং নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাকে আইনী পোশাক পড়াতে এর ওপর জারি করা হয়েছে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’। কীভাবে? তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই লেখায়।

ভূমিকা

ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা এবং সাইবার সুরক্ষা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ অন্যান্য মৌলিক মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে পর্যাপ্ত নজর না-রেখে বাংলাদেশ সরকার মূলত রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোগুলোকে বিভিন্ন ধরনের সাইবার হামলা থেকে সুরক্ষা প্রদানের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ প্রবর্তন করে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ আইন হিসেবে কার্যকর হয়েছে ৮ অক্টোবর ২০১৮! আইনটি কার্যকর হওয়ার পর ১৫ অক্টোবর ২০১৮ থেকে ৩ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা বিচারের জন্য সাইবার ট্রাইব্যুনালে এসেছে সর্বমোট ১২২৮টি। সবচেয়ে অবাক বিষয় হলো, ১২২৮টি মামলার মধ্যে আদালত ৫৪৯টি মামলা খারিজ করে দিয়েছিল! তাহলে মামলা রইল ৬৭৯টি! প্রশ্ন জাগে, ৫৪৯টি মামলা খারিজ হওয়ার আগে কতজনকে আটক ও গ্রেফতার করা হয়েছিল? কতজনের বিরুদ্ধে এখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি, জমা দিলেও আইন মেনে জমা দিয়েছিল? আইন মেনে জমা না-দেওয়ার ফলে তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি? কতজনকে আটকের পর নির্যাতন করা হয়েছিল? আটকের আগে কতজনকে সাময়িকভাবে জোরপূর্বক গুমের শিকার হতে হয়েছিল? মামলা খারিজ হয়ে যাওয়ার পর কতদিন পর তারা হাজত থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন? মিথ্যা অভিযোগে যদি মামলা খারিজ হয়ে থাকে, তবে মুক্তি পাওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা পরিবার কি মিথ্যা অভিযোগে মামলা করেছিল? মামলা করে থাকলে কতজন করেছিল? আর ক্ষতিপূরণ? কত টাকা খরচ হয়েছে আটক থেকে মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত? আর মুক্তি পাওয়ার পর সামাজিক বঞ্চনা, বৈষম্য এবং বিভাজন? একইসঙ্গে প্রশ্ন জাগে, অনলাইনে নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্য কতগুলো মামলা হয়েছে ৬৭৯টি মামলার মধ্যে? কতগুলো মামলা প্রমাণ হয়েছে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে? কতগুলো মামলায় সাজা হয়েছে প্রমাণসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে? কতগুলো মামলা এখন চলমান? কতগুলো মামলার অভিযোগ খারিজ করে দেওয়া হয়েছে? কতগুলো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে? কতগুলো মামলা রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষক, শিল্পী, অধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে? কতগুলো লেখকদের বিরুদ্ধে? কতগুলো কৃষক এবং নাবালকদের বিরুদ্ধে?

আইনটি কার্যকর হওয়ার পর ১৫ অক্টোবর ২০১৮ থেকে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা বিচারের জন্য সাইবার ট্রাইব্যুনালে এসেছে সর্বমোট ১২২৮টি। সবচেয়ে অবাক বিষয় হলো, ১২২৮টি মামলার মধ্যে আদালত ৫৪৯টি মামলা খারিজ করে দিয়েছিল! তাহলে মামলা রইল ৬৭৯টি! প্রশ্ন জাগে, ৫৪৯টি মামলা খারিজ হওয়ার আগে কতজনকে আটক গ্রেফতার করা হয়েছিল?

চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে একটি সমীক্ষার ফল প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত এ আইনে ৭৮৩টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সমীক্ষায় বলা হয়, আইনটিতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ১৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ মামলা হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৩ দশমিক ৩৯, শিক্ষার্থীদের ২ দশমিক ৯১, শিক্ষক ২ দশমিক ৯১, বেসরকারি চাকরিজীবী ২ দশমিক ১৮, ব্যবসায়ী ২ দশমিক ১৮, সরকারি চাকরিজীবী ১ দশমিক ৭৫ ও আইনজীবী শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশ। এ আইনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযোগের ভিত্তিতে মামলার পরিমাণ ২৬ দশমিক ২৮ শতাংশ (১৯ মার্চ ২০২১, দৈনিক যুগান্তর)।

অনলাইনে নারী শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্য কতগুলো মামলা হয়েছে ৬৭৯টি মামলার মধ্যে? কতগুলো মামলা প্রমাণ হয়েছে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে? কতগুলো মামলায় সাজা হয়েছে প্রমাণসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে? কতগুলো মামলা এখন চলমান? কতগুলো মামলার অভিযোগ খারিজ করে দেওয়া হয়েছে? কতগুলো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে? কতগুলো মামলা রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষক, শিল্পী, অধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে? কতগুলো লেখকদের বিরুদ্ধে? কতগুলো কৃষক এবং নাবালকদের বিরুদ্ধে?

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. সোহেল রানার পত্রিকায় দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৯ সালে এই আইনে ৭৩২টি মামলায় ১ হাজার ১৩৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং আর্টিকেল ১৯ বলছে, ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন মিলিয়ে মামলা হয়েছে ৭১টি (২৬ জুন ২০২০, ডিডব্লিউ)। ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মনিটরিং সেল পাঁচটি জাতীয় দৈনিক ও শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত খবরের ওপর নির্ভর করে জানায়, ২০১৯ সালে ৩৮ জন সাংবাদিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড ও হয়রানির শিকার হয়েছেন (২০ জানুয়ারি ২০২০, মানবকণ্ঠ)। বিগত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহতা লক্ষ করা গেছে ২০২০ সালে। কেননা, ২০২০ সালের প্রথম দুই মাসে ১৬৫ মামলায় ৩৩৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং করোনাকালে মার্চে অন্তত ১৩টি, এপ্রিলে ২৪টি, মে-তে ৩১টি এবং জুন মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত অন্তত ২১টি মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (২৬ জুন ২০২০, দৈনিক প্রথম আলো)।

সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা কোনো কোনো মামলায় দেখা যাচ্ছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রথমে সাময়িক সময়ের জন্য জোরপূর্বক গুম এবং পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে, যা ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা এবং নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩-এর সম্পূর্ণ পরিপন্থি। তাছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গভীর রাতে গ্রেফতার করার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবণতা আমাদের নব্বই দশকের সামরিক সরকারের আমলের মধ্যরাতের গ্রেফতারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অভিযুক্ত নারীদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। নাগরিকদের আগের অভিজ্ঞতা বলে যে, অভিযুক্তদের যেসব আইনি এবং সাংবিধানিক সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে, তা ভঙ্গ হচ্ছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে সবাই যেখানে নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করছেন, সেখানে তাদের পালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, তাই গভীর রাতে গ্রেফতার মানবাধিকার কর্মীদের ভিন্ন বার্তা দেয়।

বাংলাদেশ সরকার বিগত বছরগুলোয় তথ্যপ্রবাহ রোধ করার উদ্দেশ্যে চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত করছে এবং এই আঘাত করোনাকালে আরও ব্যাপকতা পেয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারি সম্পর্কে অবাধ তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করার পরিবর্তে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সাংবাদিক, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী, আইনজীবী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিক এবং মানবাধিকারকর্মীসহ নানা পেশায় সংযুক্ত নাগরিকের চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে মামলা-হামলা এবং আটক/গ্রেফতারের মধ্যদিয়ে। নিপীড়নমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন শুধু মামলা-হামলা এবং আটক/গ্রেফতারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতা, চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার, পরিবার-পরিজনের জীবন ধারণের অধিকার, ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকারসহ অনেকগুলো মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে বাধা হয়েছে। নাগরিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। নিন্দনীয় হলেও সত্য, শুধু আটক এবং গ্রেফতারের মধ্যে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ থাকছে না, অনেক ব্যক্তিকে হারাতে হচ্ছে সামাজিক-মানবিক মর্যাদা, কর্মসংস্থান এবং মুখোমুখি হতে হচ্ছে পুনরায় মিথ্যা মামলায় শিকার হওয়ার হুমকির, অনেকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন এবং লাঞ্ছনারও শিকার হয়েছেন।

যারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করছেন, তারা মূলত স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি কিংবা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। এই প্রতিযোগিতায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শুধু মামলা করে ছাড় দিচ্ছে না; বরং সেসব মামলায় গ্রেফতারও নিশ্চিত করেছে

করোনাকালে মামলার শিকার আটক ব্যক্তিদের ওপর মূলত অভিযোগ ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘অবমাননাকর, গুজবনির্ভর, আপত্তিকর, কটূক্তিমূলক, কার্টুন বা ব্যঙ্গাত্মক চিত্র আঁকা এবং মানহানিকর’ বক্তব্য প্রদানের। অন্যদিকে, যারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করছেন, তারা মূলত স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি কিংবা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। এই প্রতিযোগিতায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শুধু মামলা করে ছাড় দিচ্ছে না; বরং সেসব মামলায় গ্রেফতারও নিশ্চিত করেছে। এমনকি এই নিপীড়নমূলক আইনের সুযোগ নিয়ে সর্বশেষ মানহানির মামলার অপব্যবহারও দেখতে পাচ্ছি। আন্তর্জাতিক সংগঠন আর্টিকেল-১৯-এর তথ্যমতে, প্রয়াত সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নাম উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘মানহানিকর’ পোস্ট দেওয়ার ‘কটূক্তির’ অভিযোগে ডিজিটাল আইনে ৯টি মামলা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয় (২৬ জুন ২০২০, ডিডব্লিউ)। প্রায় একই ধরনের অভিযোগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহিরের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছে এবং কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতাকে বিশেষভাবে ঝুঁকিতে ফেলেছে। করোনাভাইরাস সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করার কারণে সাতজন সরকারি কলেজের শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে করোনা সংক্রান্ত গবেষণা করার কারণে তদন্ত চলছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতাকে বিশেষভাবে ঝুঁকিতে ফেলেছে। করোনাভাইরাস সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করার কারণে সাতজন সরকারি কলেজের শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে করোনা সংক্রান্ত গবেষণা করার কারণে তদন্ত চলছে

এই বাস্তবতায়, আইনি পর্যালোচনামূলক প্রবন্ধটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির মৌলিক মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে গঠনমূলক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা। উল্লেখ্য, বিশ্লেষণটি বিশেষ কয়েকটি ধারার মধ্যে সীমিত—সময় ও স্থান সংকুলানের কথা বিবেচনা করে। এই আইনি পর্যালোচনাটি মূলত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবর্তনের সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপট, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ধারণাসমূহ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন নিপীড়নমূলক ধারাসমূহের মানবাধিকার দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা এবং সবশেষে আইনটি বাতিলের প্রশ্ন।

এই প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি গঠনমূলক বিশ্লেষণ করার জন্য মূলত, আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত চুক্তির ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদ, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত কমিটি কর্তৃক ১৯ ধারার ওপর ব্যাখ্যাদানকারী জেনারেল কমেন্ট ৩৪ এবং জোহানেসবার্গ প্রিন্সিপলস অন ন্যাশনাল সিকিউরিটি, তসছ্বান (Tshwane) ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন অ্যান্ড এক্সেস টু ইনফরমেশন নীতিমালার ওপর নজর রাখা হয়েছে এবং বাংলাদেশের সংবিধান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (সংশোধিত ২০০৯ এবং ২০১৫ সাল) ও বিধিমালার আলোকে এই নিবর্তনমূলক আইনটি পর্যালোচনা করা হয়েছে। একইসঙ্গে, ২০১১ সালের মে মাসে জেনেভায় উপস্থাপিত জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সতেরোতম অধিবেশনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার প্রসার ও সুরক্ষায় জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রাঙ্ক লা রু-এর একটি প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করা হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবর্তনের সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আইনগত বৈধতা ও নিরাপত্তা প্রদান এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি বিবেচনা করে, ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (সংশোধিত ২০০৯ এবং ২০১৩) এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা-২০১৫ ছাড়াও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন-২০০১ সংক্রান্ত নীতিমালা দ্বারা সরকার ২০১৫ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত সাইবার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা এবং ব্যবস্থাপনা চালিয়ে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের মে মাসে সরকার হঠাৎ করে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে নতুন আরও একটি নিবর্তনমূলক আইন নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ এবং আলাপ-আলোচনা ছাড়াই প্রবর্তন করার প্রক্রিয়া গ্রহণ করে। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকবার সাইবার সংক্রান্ত অপরাধের শিকার হয়েছে এবং এ ধরনের অপরাধ দমনে বা বিদ্যমান আইনে যা নেই, সেটিই নতুন আইনে রাখা হয়েছে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ‘সাইবার ঝুঁকি নিরসনে’ ১১ মার্চ ২০১৪ তারিখে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭’ এর বরখেলাপ করে ইংরেজিতে ‘জাতীয় সাইবার সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি’ অনুমোদন করে ও আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের গ্লোবাল সাইবার সিকিউরিটি এজেন্ডা উপস্থাপন করে। বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭-এর ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে: ‘বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে।’ এবং ৩(২)-এ বলা হয়েছে: ‘উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহা হইলে উহা বে-আইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’

পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও দেশীয় সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং মানবাধিকারকর্মীদের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’ পাস হয় এবং ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর থেকে আইনটি কার্যকর রয়েছে। ৮ মার্চ ২০২০ সালে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮-এর অধীন ডিজিটাল নিরাপত্তা বিধিমালা-২০২০ জারি করে (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার)। নাগরিক সুরক্ষা এবং অধিকারের দিক থেকে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু বাস্তবতা রয়েছে বলে দাবি করা হলেও, এ আইনে এমন অনেকগুলো বিধান রাখা হয়েছে, যেগুলো নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার ও নানাবিধ নাগরিক অধিকারকে সীমিত করছে এবং নাগরিকদের জনবান্ধব কর্মকাণ্ডকে অপরাধীকরণ করেছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবর্তন হওয়ার আগে, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত, বাংলাদেশের নাগরিকরা একই রকম রাজনৈতিক বাস্তবতায় নিষ্পেষিত ছিলেন। সেসময় ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬’ এর বিভিন্ন ধারায়, বিশেষ করে ৪৬ ও ৫৭ ধারার ব্যাপক অপপ্রয়োগের শিকার হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ। এখানে উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ধারাবলে, ৬৬ ভাগ মামলা প্রমাণ করা যায়নি, ১৩ ভাগ মামলা তদন্ত পর্যায়েই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং ৯৪ ভাগ মামলাই হচ্ছে বিতর্কিত ৫৭ ধারার। এছাড়াও পত্রিকার তথ্যমতে, সাইবার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালের মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তদন্তে ঘটনার সত্যতা না-পেয়ে তিন বছরে ৪৬টি মামলায় পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে (২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, দৈনিক প্রথম আলো)। যার মধ্যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা ১০টি মামলার ৪টি, যা কিনা তদন্তে ঘটনার সত্যতা না-পেয়ে পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এই অপপ্রয়োগের ধারাবাহিকতায় ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’ পাস করা হয় এবং এই আইনের দ্বারা ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্তও করা হয়। কিন্তু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬-এর এই পাঁচটি ধারা বিলুপ্তকরণের মধ্যদিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সংক্রান্ত নিপীড়ন শেষ হয়ে যায়নি; বরং বেড়েছে, বেড়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮-এর প্রয়োগ। নাম প্রকাশ না-করার শর্তে পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এখনো পরিস্থিতি একই রকম। এই হারে মামলা হলে বছর শেষে মামলার হার গত বছরের তুলনায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে’ (২৬ জুন ২০২০, দৈনিক প্রথম আলো)।

২০০৬ সালের তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ধারাবলে, ৬৬ ভাগ মামলা প্রমাণ করা যায়নি, ১৩ ভাগ মামলা তদন্ত পর্যায়েই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং ৯৪ ভাগ মামলাই হচ্ছে বিতর্কিত ৫৭ ধারার

বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নিপীড়নমূলক ধারাসমূহের দ্বারা কত শতাংশ মামলা প্রমাণ করা যায়নি, কিংবা কত শতাংশ মামলা তদন্ত পর্যায়েই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, কিংবা কত শতাংশ মামলা বিতর্কিত ধারাসমূহের–তা নাগরিকদের অজানা। এমনকি কতগুলো মামলার গত দুবছর ছয় মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে, কতজন জামিনে মুক্ত আছেন এবং কতজন এখন পর্যন্ত কারাগারে আছেন–তা-ও রয়েছে অজানা।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ধারণাসমূহ

যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক ভিত্তিগুলোর অন্যতম হচ্ছে চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ। ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র’-এর ১৯ অনুচ্ছেদে নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করার উল্লেখ আছে। এছাড়াও জাতিসংঘের প্রস্তুতকৃত ইন্টারন্যাশনাল কোভেনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস-এর (আইসিসিপিআর) কিংবা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত চুক্তির ১৯ অনুচ্ছেদেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ এই আন্তর্জাতিক সনদটির অনুস্বাক্ষর এবং অনুসমর্থনকারী একটি রাষ্ট্র। অতএব আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বিধিবিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় মহলে বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ সনদের অনুস্বাক্ষর এবং অনুসমর্থনকারী রাষ্ট্র হিসেবে, তার নিজ দেশে গৃহীত যেকোনো আইন বা বিধিবিধান এই আন্তর্জাতিক সনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না-হয়ে যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, সে বিষয়টির ওপর নজর দিতে হবে। এই প্রত্যাশা শুধু বাংলাদেশের নাগরিকদের নয়, আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক মহলেরও। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ উল্লেখ্য। এই অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে, (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।

বাংলাদেশ এই আন্তর্জাতিক সনদটির অনুস্বাক্ষর এবং অনুসমর্থনকারী একটি রাষ্ট্র। অতএব আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বিধিবিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় মহলে বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ সনদের অনুস্বাক্ষর এবং অনুসমর্থনকারী রাষ্ট্র হিসেবে, তার নিজ দেশে গৃহীত যেকোনো আইন বা বিধিবিধান এই আন্তর্জাতিক সনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নাহয়ে যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, সে বিষয়টির ওপর নজর দিতে হবে

আন্তর্জাতিক সনদগুলো ডিজিটাল বা অনলাইন মাধ্যমকে বিবেচনায় রেখে না-করা হলেও, তত্ত্বগত বা উদ্দেশ্যগতভাবে ডিজিটাল বা অনলাইন কার্যক্রমের বিধিবিধান এই সনদের আওতার মধ্যেই পড়ে। জাতিসংঘের অধিবেশনে গৃহীত রেজুলেশনসমূহ, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত কমিটি কর্তৃক ১৯ ধারার ওপর ব্যাখ্যাদানকারী জেনারেল কমেন্ট ৩৪ এবং জাতিসংঘের বিশেষ দূত কর্তৃক বিভিন্ন প্রতিবেদনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ধারণাসংক্রান্ত বিষয়াবলি আরও স্পষ্ট, বিস্তৃত ও বিশদভাবে ব্যাখ্যা ও বর্ণিত হয়েছে। তবে জেনারেল কমেন্ট ৩৪ এবং জাতিসংঘের বিশেষ দূত কর্তৃক প্রতিবেদনসমূহ অনুসারে অফলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের তত্ত্বগত লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য, একইভাবে ডিজিটাল বা অনলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।

ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনের বাংলা অনুবাদ ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ করা হয়ে থাকলেও এর ব্যাপ্তি শুধু সাংবিধানিক বা আইনি ধারণার মাঝে সীমিত নয়। চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া কোনো সুস্থ ও সক্রিয় রাজনৈতিক পরিসর গড়ে উঠতে পারে না। বিভিন্ন গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের দমন, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতার শর্ত তৈরি করে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে শুধু কথা বলে বা লিখে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাই নয়, অন্যান্য যেকোনো উপায়ে অভিব্যক্তি প্রকাশ করাও এর অন্তর্গত। জীবন ধারণের অধিকার, যোগাযোগ ও ব্যক্তিগত তথ্য গোপনীয়তার অধিকার, ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকারসহ অনেকগুলো মৌলিক অধিকারের সঙ্গেও মানুষের পরস্পরের সঙ্গে নির্ভয়ে কথা বলা এবং মতের আদান-প্রদান সম্পর্কিত। একদিকে নাগরিকদের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ যেমন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আবশ্যক, তেমনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ অন্যান্য নাগরিক স্বাধীনতা মানে এই নয় যে, কোনো নির্দিষ্ট জাতি, বর্ণ, ধর্মীয় বা গোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানো এর অন্তর্গত হবে।

চিন্তা, বিবেক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া কোনো সুস্থ সক্রিয় রাজনৈতিক পরিসর গড়ে উঠতে পারে না। বিভিন্ন গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে চিন্তা, বিবেক মতপ্রকাশের দমন, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা সহিংসতার শর্ত তৈরি করে

কোনো রাষ্ট্র কী কী বিবেচনায় কারো মতপ্রকাশকে সীমিত করতে পারবে, তা আইসিসিপিআর-এর ১৯(৩) নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে: ‘অন্যের অধিকার বা খ্যাতি রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এবং নিদিষ্ট শর্তসাপেক্ষে জাতীয় নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্য ও নীতিনৈতিকতা রক্ষার্থে রাষ্ট্র কারো মতপ্রকাশ সীমিত করতে পারবে।’ এছাড়াও জোহানেসবার্গ প্রিন্সিপলস অন ন্যাশনাল সিকিউরিটি, তসছ্বান (Tshwane) ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন অ্যান্ড এক্সেস টু ইনফরমেশন নীতিমালায় উল্লেখ আছে যে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে আইন কর্তৃক নির্ধারিত এবং বৈধ হতে হবে। বৈধতার ভিত্তি গণতন্ত্র সুরক্ষার কর্তব্য হিসেবে নাগরিকদের কাছে পরিষ্কার থাকতে হবে। সর্বোপরি, অধিকার সীমিতকরণ অবশ্যই প্রয়োজনের তুলনায় মাত্রাতিরিক্ত হবে না। এখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে তথ্য পাওয়ার অধিকার, তথ্য সংরক্ষণ করার অধিকার এবং তথ্য সরবরাহ করার অধিকারও অন্তর্গত।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন গোপনীয়তার অধিকারের প্রচার সুরক্ষার জন্য সুস্পষ্ট এবং সর্বজনীন কাঠামো সরবরাহ করে থাকে। অনেকগুলো আন্তর্জাতিক দলিলসমূহে গোপনীয়তার অধিকার সংযুক্ত করা হয়েছে, যেগুলোয় বাংলাদেশ রাষ্ট্র স্বাক্ষর এবং অনুসমর্থন করেছে

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন গোপনীয়তার অধিকারের প্রচার ও সুরক্ষার জন্য সুস্পষ্ট এবং সর্বজনীন কাঠামো সরবরাহ করে থাকে। অনেকগুলো আন্তর্জাতিক দলিলসমূহে গোপনীয়তার অধিকার সংযুক্ত করা হয়েছে, যেগুলোয় বাংলাদেশ রাষ্ট্র স্বাক্ষর এবং অনুসমর্থন করেছে। সেগুলো হলো: অনুচ্ছেদ ১২–সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা-১৯৪৮, অনুচ্ছেদ ১৭–নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি-১৯৬৬, অনুচ্ছেদ ১৬–শিশু অধিকার সনদ-১৯৮৯, অনুচ্ছেদ ১৪ অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের অধিকার সুরক্ষায় গৃহীত আন্তর্জাতিক চুক্তি-১৯৯০। উল্লেখ্য, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি-১৯৬৬-এর অনুচ্ছেদ ১৭ বলছে: ‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, পরিবার, বসতবাড়ি বা চিঠিপত্রের ব্যাপারে খেয়ালখুশিমতো হস্তক্ষেপ অথবা সম্মান ও সুনামের ওপর কাউকে বে-আইনিভাবে আক্রমণ করা চলবে না। অনুরূপ হস্তক্ষেপ কিংবা আক্রমণের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার প্রত্যেকের থাকবে।’ এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ উল্লেখ্য। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের (ক) প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হইতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকিবে; এবং (খ) চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকিবে।’

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ উল্লেখ্য। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের () প্রবেশ, তল্লাশি আটক হইতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকিবে; এবং () চিঠিপত্রের যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকিবে।

নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার ও নানাবিধ নাগরিক অধিকার রক্ষা করার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের বিশেষ দূতদের প্রতিবেদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার প্রসার ও সুরক্ষায় জাতিসংঘের বিশেষ দূতের একটি প্রতিবেদন জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ১৭তম অধিবেশনে ২০১১ সালের মে মাসে জেনেভায় উপস্থাপিত হয়। প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য হলো: ক্ষমতাশালীদের আচরণে স্বচ্ছতা আনা, তথ্য পাওয়ার অধিকার ও গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে সক্রিয় নাগরিক অংশগ্রহণের সুবিধা বাড়ানোর লক্ষ্যে ইন্টারনেট অংশত নিজের অন্যান্য কারিগরি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই একুশ শতকের সবচেয়ে শক্তিশালী উপকরণগুলোর একটি। আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদটির ১৭ এবং ১৯ অনুচ্ছেদ ইন্টারনেট বিষয়ে পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগযোগ্য বলে পুনর্ব্যক্ত করে জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি।

ক্ষমতাশালীদের আচরণে স্বচ্ছতা আনা, তথ্য পাওয়ার অধিকার গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে সক্রিয় নাগরিক অংশগ্রহণের সুবিধা বাড়ানোর লক্ষ্যে ইন্টারনেট অংশত নিজের অন্যান্য কারিগরি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই একুশ শতকের সবচেয়ে শক্তিশালী উপকরণগুলোর একটি। আন্তর্জাতিক নাগরিক রাজনৈতিক অধিকার সনদটির ১৭ এবং ১৯ অনুচ্ছেদ ইন্টারনেট বিষয়ে পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগযোগ্য বলে পুনর্ব্যক্ত করে জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি

ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য খোঁজা, পাওয়া ও ছড়িয়ে দিতে সব ব্যক্তির অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা ও চ্যালেঞ্জগুলোও খতিয়ে দেখে প্রতিবেদনটি। শুধু মত ও অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাধীনতায় ব্যক্তিকে অধিকার চর্চায় সক্ষম করার জন্যই নয়; বরং অন্যান্য অনেক মানবাধিকার চর্চায় এবং সমাজে সামগ্রিকভাবে প্রগতির প্রসারে ইন্টারনেটের রূপান্তরমান চরিত্রের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেন বিশেষ দূত। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেটে মত ও অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের নিয়ম-আদর্শ ও মানদণ্ডের প্রয়োগ-যোগ্যতা চিহ্নিত করা হয় প্রতিবেদনটির তৃতীয় পরিচ্ছেদে। এছাড়া বেশকিছু ব্যতিক্রম অবস্থা চিহ্নিত করা হয়, যেখানে নির্দিষ্ট ধরনের কোনো কোনো তথ্যের ছড়িয়ে পড়া সীমিত করা যাবে। পরিচ্ছেদ ৪ ও ৫-এ ইন্টারনেট ব্যবহারের দুটি মাত্রার বিষয়ে বলা হয়: ক. ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার; ও খ. ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দরকারি বস্তুগত ও কারিগরি অবকাঠামোয় প্রবেশাধিকার। চতুর্থ পরিচ্ছেদটি আরো বিশেষভাবে এমন কিছু উপায় চিহ্নিত করেছে, যেসব উপায়ে রাষ্ট্রগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে অনলাইনে তথ্য সেন্সর করছে। এগুলো হচ্ছে: অযাচিতভাবে বিষয়বস্তু ব্লক অথবা ফিল্টার করা, বৈধ অভিব্যক্তির প্রকাশকে অপরাধ প্রতিপন্ন করা, মধ্যবর্তী দায় আরোপ, ব্যবহারকারীদের ইন্টারনেট সুবিধা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার আইনে অন্তর্ভুক্ত করা, সাইবার আক্রমণ এবং গোপনীয়তার অধিকার ও তথ্য সুরক্ষার অধিকারের অপর্যাপ্ত সুরক্ষা। পঞ্চম পরিচ্ছেদে আলোচনা করা হয় সর্বজনীন ইন্টারনেট সুবিধার বিষয়টি। এই প্রতিবেদনের সঙ্গে জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কতটুকু সামঞ্জস্য রয়েছে, তা নির্ধারণের জন্য এখন দেশগুলোর পরিস্থিতি গভীরভাবে নির্ণয় করা দরকার।

নাগরিক অধিকার হরণের বাস্তবতা এবং ধারাসংক্রান্ত বিবরণী

নিপীড়নমূলক ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’-এর বেশ কয়েকটি ধারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতি, নৈতিকতা এবং মানদণ্ডের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং মানুষকে হয়রানির উদ্দেশ্যে সহজে ব্যবহার করা যায়। এই আইনটি ব্যবহার করে দায়ের করা প্রতিটি মামলা গণমাধ্যমসহ নাগরিকদের চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ জীবনের অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারে।

. সংজ্ঞায়নের অস্পষ্টতা অপ্রতুলতা

ধারা আইন যা বলে পর্যালোচনা
২(খ) ‘উপাত্তভান্ডার’ অর্থ টেক্সট, ইমেজ, অডিও বা ভিডিও আকারে উপস্থাপিত তথ্য, জ্ঞান, ঘটনা, মৌলিক ধারণা বা নির্দেশাবলি, যাহা–(অ) কোনো কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক দ্বারা আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা হইতেছে বা হইয়াছে; এবং(আ) কোনো কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করা হইয়াছে; এই সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সংজ্ঞাটিতে উপাত্তভান্ডার সংজ্ঞায়নের পরিবর্তে ডিজিটাল উপাত্তের সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে। ডেটা স্টোরেজ সাধারণত স্টোরেজ মিডিয়ামে ডেটা রেকর্ডিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা কম্পিউটার সিস্টেম বা ক্লাউডের মতো অন্যান্য প্রযুক্তি হতে পারে।
২(ছ) ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো (Critical Information Infrastructure)’ অর্থ সরকার কর্তৃক ঘোষিত এইরূপ কোনো বাহ্যিক বা ভার্চুয়াল তথ্য পরিকাঠামো যাহা কোনো তথ্য-উপাত্ত বা কোনো ইলেকট্রনিক তথ্য নিয়ন্ত্রণ, প্রক্রিয়াকরণ, সঞ্চারণ বা সংরক্ষণ করে এবং যাহা ক্ষতিগ্রস্ত বা সংকটাপন্ন হইলে–(অ) জননিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বা জনস্বাস্থ্য,(আ) জাতীয় নিরাপত্তা বা রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা বা সার্বভৌমত্বের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়িতে পারে; ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো (Critical Information Infrastructure)’ সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে দুটি পদ্ধতির বিষয় লক্ষ করা যায়: এক পক্ষ নিরাপত্তার বিষয় প্রাধান্য দিয়ে থাকে এবং আরেক পক্ষ রাষ্ট্রের এবং নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তথ্য অবকাঠামো কেবল তখনই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে যদি সরকার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো বজায় রাখার জন্য সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে বা সংজ্ঞাটিতে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন আগ্রহের সুরক্ষার গ্যারান্টি দেয়। কেবল বিরূপ প্রভাবই যথেষ্ট নয়। বিভিন্ন দেশের আইনে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ বলতে কোন কাঠামো গণ্য করা হবে, তা-ও আইনের মাধ্যমেই নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।সার্বিক পর্যালোচনায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মূলত ‘নিরাপত্তার বিষয়’-কে প্রাধান্য দিয়েছে। এই ধারায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোর সংজ্ঞা যথেষ্ট স্পষ্ট না-হওয়ায় এবং কোন কোন কম্পিউটার সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক এর অন্তর্গত হবে, তা নির্ধারিত না-থাকায় অনেকের কাছেই এর সংজ্ঞা অস্পষ্ট মনে হতে পারে। এক্ষেত্রে কেউ অপরাধ করছেন কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত না-হয়েই বা ভুলবশত কোনো অপরাধ করে ফেলতে পারেন। একইসঙ্গে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’র বিরুদ্ধে অপরাধ বলতে কী ধরনের কার্যক্রম বোঝাবে, তারও কোনো সুস্পষ্ট ধারণা না-থাকায় কেউ এই ধারার ভুল শিকার হতে পারেন। অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোর কোনো তথ্য বা উপাত্ত অননুমোদিতভাবে প্রকাশ করাকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করার সুযোগ রয়েছে। জোহানেসবার্গ প্রিন্সিপলের সুপারিশ মোতাবেক কোনো গোপন তথ্য প্রকাশ অপরাধ হবে-না, যদি-না তথ্য প্রকাশ ন্যায়সংগত জাতীয় নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত না-করে বা করার মতো না-হয়। যদি ন্যায়সংগত জাতীয় নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে; কিন্তু সেক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণের চেয়ে জনস্বার্থ অধিক জরুরি বা মূল্যবান হয়, তবে সেক্ষেত্রে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। কিন্তু অত্যাবশ্যকীয় তথ্য পরিকাঠামো সম্পর্কিত সংজ্ঞা ও ধারায় এসবের উল্লেখ না-থাকায় সরকার বা সরকারের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যা অত্যাবশ্যকীয় তথ্য পরিকাঠামোর অন্তর্গত তার কোনো দুর্নীতি, অসদাচরণ বা অপরাধ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা কোনো প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে সংবাদমাধ্যম কর্মীদের নিরুৎসাহিত করবে। এক্ষেত্রে কেউ কোনো গোপন তথ্য প্রকাশ করলে, যা জোহানেসবার্গ প্রিন্সিপল অনুসারে অপরাধ হিসেবে গণ্য নয়; কিন্তু এই ধারায় অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত হতে পারেন। এছাড়াও ২(৩)(খ) ধারা এই সরকার কর্তৃক ‘অত্যাবশ্যকীয় তথ্য পরিকাঠামো’ ঘোষণার বিধান রাখার ফলে একদিকে এই ঘোষণা সরকার বা সরকারের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, অপরাধ বা অসদাচরণ গোপন করার অভিপ্রায়ে ব্যবহার হতে পারে। অন্যদিকে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা সংবাদকর্মী কর্তৃক ওই দুর্নীতি, অপরাধ বা অসদাচরণ প্রকাশের পথ সংকুচিত করবে। (পরবর্তী সময়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে)
২(ট) ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা’ অর্থ কোনো ডিজিটাল ডিভাইস বা ডিজিটাল সিস্টেম-এর নিরাপত্তা; এটি সুরক্ষার অর্থ কী তা সংজ্ঞায় নির্ধারণ করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। কমপক্ষে কম্পিউটার সিস্টেমে রাখা ইলেকট্রনিক তথ্য বা বহিরাগতদের দ্বারা অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে স্থাপন করা সরঞ্জাম বা অন্যান্য ব্যবস্থার বিষয়ে উল্লেখ করা উচিত ছিল।
২(থ) ‘বে-আইনি প্রবেশ’ অর্থ কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে বা উক্তরূপ অনুমতির শর্ত লঙ্ঘনক্রমে কোনো কম্পিউটার বা ডিজিটাল ডিভাইস বা ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা ডিজিটাল তথ্য ব্যবস্থায় প্রবেশ বা উক্তরূপ প্রবেশের মাধ্যমে উক্ত তথ্য ব্যবস্থার কোনো তথ্য-উপাত্তের আদান-প্রদানে বাধা প্রদান বা উহার প্রক্রিয়াকরণ স্থগিত বা ব্যাহত করা বা বন্ধ করা বা উক্ত তথ্য-উপাত্তের পরিবর্তন বা পরিবর্ধন বা সংযোজন বা বিয়োজন করা অথবা কোনো ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে কোনো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ; প্রথমত, আন্তর্জাতিক সাইবার চুক্তিতে বে-আইনি প্রবেশসহ অবৈধ বাধা, ডেটা হস্তক্ষেপ ও সিস্টেমের হস্তক্ষেপকে আলাদা করে সংজ্ঞায়ন করেছে। কিন্তু ‘বে-আইনি প্রবেশ’-এর এই সংজ্ঞায়নে সব বিষয়কে একসঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা অপপ্রয়োগ হতে পারে।
২(প) (প) ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ অর্থ যেসব মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহিদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল–জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সব আদর্শ; জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা–এগুলো প্রতিটি আদর্শকেন্দ্রিক মতাদর্শ। যেকোনো আদর্শভিত্তিক চেতনা রাজনৈতিক মত এবং বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এসব বিষয়ে গবেষকদের নানা মতপার্থক্য ও পর্যালোচনা রয়েছে। সুতরাং সরকারি ভাষ্যের থেকে ভিন্ন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণেরও সুযোগ রয়েছে।
২(ফ) ‘সেবা প্রদানকারী’ অর্থ–(অ) কোনো ব্যক্তি যিনি কম্পিউটার বা ডিজিটাল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো ব্যবহারকারীকে যোগাযোগের সামর্থ্য প্রদান করেন; বা(আ) এমন কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা সংস্থা, যিনি বা যাহা উক্ত সার্ভিসের বা উক্ত সার্ভিসের ব্যবহারকারীর পক্ষে কম্পিউটার ডেটা প্রক্রিয়াকরণ বা সংরক্ষণ করেন। অন্যান্য দেশের তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য, এই সংজ্ঞাটি অত্যধিক বিস্তৃত হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। (পরবর্তী সময়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে)

এই আইনে ধারা ১৭ (গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোয় বে-আইনি প্রবেশ), ধারা ১৮ (কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদিতে বে-আইনি প্রবেশ), ধারা ১৯ (কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদির ক্ষতিসাধন), ধারা ২০ (কম্পিউটার সোর্স কোড পরিবর্তন সংক্রান্ত অপরাধ), ধারা ৩৩ (বে-আইনিভাবে তথ্য-উপাত্ত ধারণ, স্থানান্তর) এবং ধারা ৩৪ (হ্যাকিং সম্পর্কিত অপরাধ)–এ তিনটি লক্ষণীয় বিষয়:

প্রথমত, এই ধারাগুলোয় জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট হ্যাকিং এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের হ্যাকিংকে পার্থক্য করা হয়নি।

দ্বিতীয়ত, সাইবার ক্রাইম চুক্তিতে এসব অপরাধের অনেকগুলো সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে, যার সব কটি আইনে উল্লেখ করা হয়নি এবং আইনে অনেকগুলো অপরাধের সংকীর্ণ সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে এবং অপরাধের অভিপ্রায় সম্পর্কে পর্যাপ্ত নজর রাখা হয়নি।

তৃতীয়ত, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপরাধসমূহের অনেকগুলোকেই ইতোমধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বিভিন্ন ধারায় অপরাধী করা হয়েছে। এই আইনের এতগুলো অপরাধকে ভিন্ন ভিন্ন ধারায় ব্যাখ্যা করার ফলে ধারাসমূহ অত্যধিক বিস্তৃত, যা আন্তর্জাতিক সাইবার ক্রাইম চুক্তির বিকশিত মানগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেও করা সম্ভব হয়নি। যার ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেকগুলো ধারা সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অপরাধী করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

আইনের অধীন ধারা ৩৫ বলছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ এবং অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করিবার ক্ষেত্রে, মূল অপরাধটির জন্য যে দণ্ড নির্ধারিত রহিয়াছে, কোনো ব্যক্তি সেই দণ্ডেই দণ্ডিত হইবেন।’ এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়:

প্রথমত, যেকোনো আইনে অপরাধে সহায়তা করা এবং প্রত্যক্ষ অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে শাস্তির পার্থক্য থাকে; কিন্তু এই আইনে সেটি করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, ‘অপরাধ সংঘটনে সহায়তা’র সংজ্ঞায়ন করা হয়নি এবং অপরাধে সহায়তার ক্ষেত্রে অভিপ্রায়ের বিষয়টিও নজর দেওয়া হয়নি।

. বিস্তৃত অতিরাষ্ট্রিক (extraterritorial) এখতিয়ার প্রয়োগ এবং সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের আশঙ্কা

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪ ধারায় আইনটির অতিরাষ্ট্রিক (extraterritorial) এখতিয়ার প্রয়োগের বিধান জারি করা হয়েছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের বাহিরে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন যাহা বাংলাদেশে সংঘটন করিলে এই আইনের অধীন দণ্ডযোগ্য হইত, তাহা হইলে এই আইনের বিধানাবলি এইরূপে প্রযোজ্য হইবে যেন উক্ত অপরাধটি তিনি বাংলাদেশেই সংঘটন করিয়াছেন।’ আবার, ৪(২) ধারায় বলা হয়েছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের বাহির হইতে বাংলাদেশে অবস্থিত কোনো কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সাহায্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের বিধানাবলি এইরূপে প্রযোজ্য হইবে যেন উক্ত অপরাধের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া বাংলাদেশেই সংঘটিত হইয়াছে।’ একইসঙ্গে ৪(৩) ধারায় বলা হয়েছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তর হইতে বাংলাদেশের বাহিরে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে এই আইনের বিধানাবলি এইরূপে প্রযোজ্য হইবে যেন উক্ত অপরাধের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া বাংলাদেশেই সংঘটিত হইয়াছে।’

বাংলাদেশ খুব কম আইনে অতিরাষ্ট্রিক (extraterritorial) এখতিয়ার প্রয়োগের কথা বলা হয়ে থাকে, তবে আইনের নীতির জায়গা থেকে তা নতুন নয়। কিন্তু ব্যবহারিক দিক থেকে দেখতে গেলে রাষ্ট্রকে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে, বিশেষ করে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের এবং আদালতকে। এসব সমস্যার মধ্যে অন্যতম হলো, যথাযথ আইনি নিয়ম মেনে অন্য আরেকটি রাষ্ট্র থেকে প্রয়োজনীয়, পর্যাপ্ত এবং যথাযথ তথ্য সংক্রান্ত প্রমাণাদি জোগাড় করার ক্ষেত্রে, অতিরাষ্ট্রিক (extraterritorial) প্রয়োগের বিধানটি খুব বেশি মাত্রায় বিস্তৃত, অপরিষ্কার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের দিকেও পরিচালিত হতে পারে। আমরা মনে করি, দেশের আইনে অতিরাষ্ট্রিক (extraterritorial) এখতিয়ার প্রয়োগের বিধান কেবল তখনই প্রয়োগ করা উচিত, যখন অপরাধটির সঙ্গে সত্যিকারের এবং উল্লেখযোগ্য সংযোগ স্থাপন করা যাবে এবং আদালত ও তদন্তকারী সংস্থাসমূহ পর্যাপ্ত কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে সমর্থ হবে। অতিরাষ্ট্রিক (extraterritorial) এখতিয়ারের অনুশীলনের সবচেয়ে কঠিন দিকটি হলো, এখানে একাধিক রাষ্ট্রের এখতিয়ারের দাবি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি রাষ্ট্র ‘ক’-তে অবস্থানরত রাষ্ট্র ‘খ’-এর নাগরিক, রাষ্ট্র ‘গ’ নাগরিকের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করে, তবে তিনটি রাষ্ট্রেরই বৈধ ভিত্তি থাকতে পারে। যাতে করে রাষ্ট্রসমূহ নিজ নিজ রাষ্ট্রের আইনি ও এখতিয়ারে নীতি এবং সক্রিয় ব্যক্তিত্বের নীতির ভিত্তিতে অপরাধ এবং অপরাধীর ওপর এখতিয়ার প্রয়োগ করতে ও চাইতে পারেন।

দেশের আইনে অতিরাষ্ট্রিক (extraterritorial) এখতিয়ার প্রয়োগের বিধান কেবল তখনই প্রয়োগ করা উচিত, যখন অপরাধটির সঙ্গে সত্যিকারের এবং উল্লেখযোগ্য সংযোগ স্থাপন করা যাবে এবং আদালত তদন্তকারী সংস্থাসমূহ পর্যাপ্ত কারিগরি জ্ঞান দক্ষতা অর্জন করতে সমর্থ হবে

এই ধারার কারণে আইনসভা, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মাধ্যমে জাতীয় আইনকে বহিরাগতভাবে প্রয়োগ এবং আন্তঃরাষ্ট্র দ্বন্দ্বের যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে:

১) কখন একটি রাষ্ট্র তার অঞ্চলের বাইরে সংঘটিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, তদন্ত কিংবা নিজ রাষ্ট্রীয় এখতিয়ারে পরিচালনা করতে পারে; এবং ২) দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের মাঝে বিচার বিভাগের অধিক্রমণের সমাধান কেমন হওয়া উচিত?

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের () ধারা অনুযায়ী, মহাপরিচালকের নিজ অধিক্ষেত্রভুক্ত কোনো বিষয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্যউপাত্ত ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করিলে তিনি উক্ত তথ্যউপাত্ত অপসারণ বা ক্ষেত্রমতো ব্লক করিবার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে, অতঃপর বিটিআরসি বলিয়া উল্লিখিত, অনুরোধ করিতে পারিবেন

. মহাপরিচালকের তথ্যউপাত্ত অপসারণ অথবা ক্ষেত্রমতে ব্লক করার ক্ষমতা

সরকারের মতে, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’ মূলত রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোগুলোকে বিভিন্ন ধরনের সাইবার হামলা থেকে সুরক্ষা প্রদানের জন্য তৈরি করা হলেও, কার্যত এর ভিন্ন উদ্দেশ্য দেখা যায়। নাগরিকদের ব্যক্তিগত সাইবার সুরক্ষা এর মূল লক্ষ্য নয়। বলা হয়েছে, এই সুরক্ষা প্রদানের কাজটি সম্পাদিত হবে একজন মহাপরিচালক ও দুজন পরিচালকের সমন্বয়ে গঠিত ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মাধ্যমে। এজেন্সি ডিজিটাল মাধ্যমে যেকোনো তথ্য অপসারণ করার নির্দেশ প্রদান করতে পারবে এবং যেকোনো কম্পিউটার সিস্টেমে পূর্বানুমতি ছাড়াই প্রবেশ করতে পারবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮(১) ধারা অনুযায়ী, ‘মহাপরিচালকের নিজ অধিক্ষেত্রভুক্ত কোনো বিষয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করিলে তিনি উক্ত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ক্ষেত্রমতো ব্লক করিবার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে, অতঃপর বিটিআরসি বলিয়া উল্লিখিত, অনুরোধ করিতে পারিবেন’ এবং ৮(২) ‘যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট প্রতীয়মান হয় যে, ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের বা উহার কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহা হইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উক্ত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করিবার জন্য, মহাপরিচালকের মাধ্যমে বিটিআরসিকে অনুরোধ করিতে পারিবে।’ এই ক্ষেত্রে ৮(১) এবং ৮(২) ধারামতে, মহাপরিচালকের নিকট থেকে কোনো অনুরোধ এলে বিটিআরসি বিষয়টি সরকারকে অবহিত করে তাৎক্ষণিকভাবে উক্ত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ক্ষেত্রমতে ব্লক করবে। এই ধারাটি বাংলাদেশের সাইবার পরিসরকে ব্লকিং, ফিল্টারিং, সেন্সরশিপের দিকে উদ্বুদ্ধ করবে, যা উদ্বেগজনক। সরকার কর্তৃক যেসব অভীষ্ট লক্ষ্য তুলে ধরা হয়, সেসব লক্ষ্যের প্রয়োজনে ব্লকিং ও ফিল্টারিং কতটা দরকারি সেটা পরিমাপ করাও কঠিন–এসব পদক্ষেপ ঘিরে স্বচ্ছতার অভাবের কারণে। এ পর্যন্ত সরকার যেসব ওয়েবসাইট ব্লক করেছে তার তালিকা এবং প্রতিটি ওয়েবসাইট ব্লক করে রাখার প্রয়োজনীয়তার পক্ষে কী ন্যায্যতা আছে, তা প্রকাশে বিগত এবং বর্তমান সরকার ব্যর্থ হয়েছে। কোন বিষয়বস্তুটি ব্লক করে রাখা উচিত, তা নির্ধারণের কাজটি অবশ্যই কোনো বিচারিক কর্তৃপক্ষ বা যেকোনো রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক অথবা যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাবের বাইরে থেকে স্বাধীন কোনো সংস্থাকে করতে হয়; কিন্তু এই আইনে সেরকম কোনো উল্লেখ নেই।

পর্যন্ত সরকার যেসব ওয়েবসাইট ব্লক করেছে তার তালিকা এবং প্রতিটি ওয়েবসাইট ব্লক করে রাখার প্রয়োজনীয়তার পক্ষে কী ন্যায্যতা আছে, তা প্রকাশে বিগত এবং বর্তমান সরকার ব্যর্থ হয়েছে। কোন বিষয়বস্তুটি ব্লক করে রাখা উচিত, তা নির্ধারণের কাজটি অবশ্যই কোনো বিচারিক কর্তৃপক্ষ বা যেকোনো রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক অথবা যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাবের বাইরে থেকে স্বাধীন কোনো সংস্থাকে করতে হয়; কিন্তু এই আইনে সেরকম কোনো উল্লেখ নেই

তবে এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, শিশু পর্নোগ্রাফির বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে স্পষ্ট ব্যতিক্রম রয়েছে–যেখানে ব্লক করার পদক্ষেপ ন্যায্য। তবে শর্ত থাকে যে, এ ব্যাপারে জাতীয় আইন হতে হবে সুনির্দিষ্ট এবং মূল উদ্দেশ্যের বাইরে গিয়ে যাতে আইনের অপব্যবহার হতে না-পারে, সে লক্ষ্যে যথেষ্ট সুরক্ষাব্যবস্থা থাকবে। এই সুরক্ষাব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনাল বা সংস্থা কর্তৃক নজরদারি। তা সত্ত্বেও, আমরা সরকারের কাছে আহ্বান জানাই, শিশু পর্নোগ্রাফির বিষয়ে শুধু ওয়েবসাইট ব্লক করার পদক্ষেপ না-নিয়ে এমন ব্যবস্থা নিতে, যাতে যারা শিশু পর্নোগ্রাফি উৎপাদন ও ছড়াচ্ছে তাদের বিচারের আওতায় আনা যায়।

বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে এই খাতে স্বায়ত্তশাসিত নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান নেই। কোনো আগাম বিজ্ঞপ্তি বা বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে কোনো ধরনের ন্যায্যতা তুলে নাধরেই যেকোনো ওয়েবসাইট ব্লক বা ফিল্টার করার এখতিয়ার বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) রয়েছে

আরও উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে এই খাতে স্বায়ত্তশাসিত নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান নেই। কোনো আগাম বিজ্ঞপ্তি বা বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে কোনো ধরনের ন্যায্যতা তুলে না-ধরেই যেকোনো ওয়েবসাইট ব্লক বা ফিল্টার করার এখতিয়ার বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) রয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন-২০০১-এর ৪৬ ধারা অনুসারে ‘এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনের উসকানি’ প্রতিরোধে সরকার যেকোনো ওয়েবসাইট ব্লক করতে পারে। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে: রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করা। তথ্য ও প্রযুক্তি আইন-২০০৬ বাতিলকৃত ৫৭ ধারায়ও এমন বিধান ছিল, যেসব ওয়েবসাইট অনৈতিকতাকে উৎসাহিত করে, তা নিষিদ্ধ করা যাবে। অথচ অনলাইনে মুক্ত ভাব প্রকাশের ওপর কোনো বাধানিষেধ আরোপ করতে হলে আন্তর্জাতিক আইনানুসারে তা তিন ধাপের ধারাবাহিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কথা রয়েছে। জাতিসংঘের ‘অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাধীনতা ও ইন্টারনেট প্রতিবেদন’-এর সুপারিশের ৬৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:

‘আর সব প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মতোই ইন্টারনেটও অন্যদের ক্ষতি করতে অপব্যবহৃত হতে পারে। অফলাইন বিষয়বস্তুর ব্যাপারে যেমন, তেমনি অনলাইন বিষয়বস্তুর ব্যাপারেও যখন ব্যতিক্রম পদক্ষেপ হিসেবে কোনো সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়, সেই পদক্ষেপকে অবশ্যই একটি তিন ধাপের ধারাবাহিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে: (১) তা অবশ্যই এমন আইনের মাধ্যমে হতে হবে, যে আইন খুব স্পষ্ট এবং সবার গোচরের মধ্যে (পূর্বানুমানযোগ্যতা ও স্বচ্ছতার নীতি); (২) তা অবশ্যই আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সনদের ১৯তম অনুচ্ছেদের ৩য় অংশে বর্ণিত উদ্দেশ্যগুলোর যেকোনো একটি পূরণকল্পে হতে হবে, এগুলো হচ্ছে: ক. অন্যদের অধিকার বা খ্যাতি রক্ষায়, খ. জাতীয় নিরাপত্তা অথবা জনশৃঙ্খলা অথবা জনস্বাস্থ্য অথবা জননৈতিকতা (ন্যায্যতার নীতি) রক্ষায় এবং গ. তা দরকারি বলে প্রমাণিত হতে হবে এবং অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে তা সবচেয়ে কম নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ হতে হবে (প্রয়োজনীয়তা ও সংগতিপূর্ণতার নীতি)। তাছাড়া অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করছে কিংবা স্বতন্ত্র গোপনীয়তার অধিকার হরণকারী এমন যে কোনো আইন অবশ্যই এমনভাবে প্রয়োগ করতে হবে, যাতে তা স্বেচ্ছাচারী ও বৈষম্যমূলক না-হয় এবং এমন একটি সংস্থার দ্বারা প্রয়োগ করতে হবে যেটি রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক অথবা অন্যান্য অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব থেকে স্বাধীন। একইসঙ্গে এর অপব্যবহারমূলক প্রয়োগের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকার লাভের ব্যবস্থাসহ এর অপব্যবহারের বিরুদ্ধে অন্যান্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা থাকতে হবে।’

মহাপরিচালক প্রয়োজনবোধে এই আইনের অধীন তাহার ওপর অর্পিত যেকোনো ক্ষমতা বা দায়িত্ব, লিখিত আদেশ দ্বারা, এজেন্সির কোনো কর্মচারী এবং অন্য কোনো ব্যক্তি বা পুলিশ অফিসারকে অর্পণ করিতে পারিবেন।

এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বা না-হওয়ার বিবেচনা না-করেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাধানিষেধের শর্তারোপ করা হয়েছে। এসব বিধান প্রায়ই শুধু বৈধ ভাব প্রকাশ বন্ধ করতেই ব্যবহৃত হয় না; বরং একটি জনগোষ্ঠীর সব সদস্যকে জোরপূর্বক স্বেচ্ছা-সেন্সরশিপের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্যও ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও আমরা যদি ৫৬ ধারার দিকে নজর রাখি তবে দেখব, ‘মহাপরিচালক প্রয়োজনবোধে এই আইনের অধীন তাহার ওপর অর্পিত যেকোনো ক্ষমতা বা দায়িত্ব, লিখিত আদেশ দ্বারা, এজেন্সির কোনো কর্মচারী এবং অন্য কোনো ব্যক্তি বা পুলিশ অফিসারকে অর্পণ করিতে পারিবেন।’ এই ৫৬ ধারার বাক্য গঠন নির্দেশ করে, এটি মূলত বিশেষায়িত একটি ক্ষমতার অর্পণ, যা একইসঙ্গে বিশাল ক্ষমতা প্রদর্শন করার সুযোগ তৈরি করবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাবে, লিখিত আদেশ দ্বারা প্রয়োজনবোধে মহাপরিচালক এজেন্সির কোনো কর্মচারী এবং অন্য কোনো ব্যক্তি বা পুলিশ অফিসারকে যে ক্ষমতা অর্পণ করবেন, তা বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় জ্ঞান বা দক্ষতা কি অর্পিত ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিদের রয়েছে? এখানে এটি বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার, ক্ষমতাটি অতিমাত্রায় বিস্তৃত এবং নাগরিকদের থেকে ‘অন্য কোনো ব্যক্তি’ বা ‘পুলিশ অফিসারকে’ নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ রয়েছে। কেননা, এ সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের নজির অনুপস্থিত এবং নাগরিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণও বটে। অন্যদিকে ‘অন্য কোনো ব্যক্তি’ কি সরকারি কর্মচারী নাকি বেসরকারি কর্মচারী? বেসরকারি কর্মচারী হলে কি তিনি সরকারের যেসব সাধারণ আচরণ বিধি উপস্থিত রয়েছে তা মেনে চলবেন এবং যদি পালন করার চেষ্টাও করে থাকেন তবে তিনি কি তা বাস্তবায়ন করতে পারবেন? একইসঙ্গে আমরা লক্ষ করি, আইনের ৫৯ ধারায় বলা হয়েছে: কোনো বিধানের অস্পষ্টতা পরিলক্ষিত হইলে সরকার, উক্ত অসুবিধা দূরীকরণার্থে, সরকারি গেজেটে প্রকাশিত আদেশ দ্বারা, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে। বাস্তবে এই ধারাটি সরকারকে এমন ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অবাধ ক্ষমতা প্রদান করে, যা সমানুপাতিকতা এবং প্রয়োজনীয়তার নীতি এবং যথাযথ তদন্ত ছাড়াই মুক্ত মতপ্রকাশের ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের লঙ্ঘন করতে পারে।

আইনের ৫৯ ধারায় বলা হয়েছে: কোনো বিধানের অস্পষ্টতা পরিলক্ষিত হইলে সরকার, উক্ত অসুবিধা দূরীকরণার্থে, সরকারি গেজেটে প্রকাশিত আদেশ দ্বারা, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে। বাস্তবে এই ধারাটি সরকারকে এমন ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অবাধ ক্ষমতা প্রদান করে, যা সমানুপাতিকতা এবং প্রয়োজনীয়তার নীতি এবং যথাযথ তদন্ত ছাড়াই মুক্ত মতপ্রকাশের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের লঙ্ঘন করতে পারে

ধারা ৬০ বলছে: ‘এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব প্রতিষ্ঠা; মহাপরিচালক কর্তৃক ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব তত্ত্বাবধান; ট্রাফিক ডেটা বা তথ্য পর্যালোচনা এবং উহা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি; হস্তক্ষেপ, পর্যালোচনা বা ডিক্রিপশন পদ্ধতি এবং সুরক্ষা; সংকটাপন্ন তথ্য পরিকাঠামোর নিরাপত্তা; ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পদ্ধতি; ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম গঠন, পরিচালনা ও অন্যান্য টিমের দলের সহিত সমন্বয়সাধন; ক্লাউড কম্পিউটিং, মেটা ডেটা; সংরক্ষিত ডেটার সুরক্ষা এবং যেকোনো বিষয়ে বিধি প্রণয়ন করতে পারবে।’ একইভাবে ধারা ৮(৪)–এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয়াদি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হইবে।

আমরা আগেই বলেছি, বাংলাদেশ সরকার ৮ মার্চ ২০২০ তারিখে নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ ব্যতীত ডিজিটাল নিরাপত্তা বিধি প্রণয়ন করেছে, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গোপনীয়তা এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের তথ্যের অধিকার সুরক্ষিত করার কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। এ আইনের ৬০ ধারার অধীন ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির জন্য তৈরি করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিধিমালা-২০২০। এই বিধিমালার আলোকে ডিজিটাল হুমকি শনাক্তকরণ, ডিজিটাল হামলা প্রতিরোধ ও প্রতিকার করার জন্য জাতীয় কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (CIRT) গঠন করবে। ডিজিটাল সাক্ষ্য সংগ্রহ করার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব গঠনের নির্দেশনা, অনুমোদন ও প্রশিক্ষণ প্রদান করতে পারবে। এজেন্সির সরবরাহ করা ডিজিটাল সাক্ষ্য হবে মামলার রায় নির্ধারণের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক, যা সরকার কর্তৃক বিরোধী/ভিন্ন মত দমনে অপব্যবহারের আশঙ্কা প্রবল। যেহেতু সরকারি আমলা দ্বারা সংস্থা পরিচালিত হবে, সেহেতু বিশ্বজনীন মানবাধিকারের নীতিসমূহের আলোকে প্রতিষ্ঠিত নাগরিকদের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এই সংস্থা কতটুকু সুরক্ষা দেবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।

. সাইবার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার অস্পষ্ট ধারণা এবং বিস্তৃত ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম

আইনের ধারা ৯-এ বলা আছে: ‘সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সির অধীন একটি ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম গঠনের সুপারিশ রয়েছে। কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি এবং প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত হইবে।’ ধারা ৯(৪)-এ বলা হচ্ছে: ‘কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, সার্বক্ষণিকভাবে দায়িত্ব পালন করিবে।’ পরবর্তী সময়ে, ৯(৫) উপধারা (৪)-এর সামগ্রিকতাকে ক্ষুণ্ন না-করিয়া কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম নিম্নবর্ণিত দায়িত্ব পালন করিবে, যথা: (ক) গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোর জরুরি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ; (খ) সাইবার বা ডিজিটাল হামলা হইলে এবং সাইবার বা ডিজিটাল নিরাপত্তা বিঘ্নিত হইলে তাৎক্ষণিকভাবে উহা প্রতিকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; (গ) সম্ভাব্য ও আসন্ন সাইবার বা ডিজিটাল হামলা প্রতিরোধের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ; (ঘ) এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকারের অনুমোদন গ্রহণক্রমে, সমধর্মী বিদেশি কোনো টিম বা প্রতিষ্ঠানের সহিত তথ্য আদান-প্রদানসহ সার্বিক সহযোগিতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ এবং (ঙ) বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্যান্য কার্য।

এখানে ‘সাইবার বা ডিজিটাল নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া’র অর্থ সুস্পষ্ট নয়। কোনো এজেন্সিকে ‘সাইবার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া’র বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষমতা দেওয়া হলেও সুস্পষ্ট ও কার্যকর ধারণার অভাবে এর অপব্যবহার বা উদ্দেশ্যবহির্ভূত ব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটি সাংবাদিক বা অন্য কোনো নাগরিক কর্তৃক সরকার বা সরকারের কোনো অংশের কোনো অসদাচরণ, অপরাধ বা ভুল কাজ ধরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তা অনলাইনে প্রকাশ করার সুযোগকে সংকুচিত করবে এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিনাশ করবে। তাই ‘সাইবার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া’র সুস্পষ্ট তথ্য ও পরিধি নির্ধারণ প্রয়োজন এবং সেটি অবশ্যই উপরে বর্ণিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে করাই সমীচীন ও কাম্য।

এখানে সাইবার বা ডিজিটাল নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া অর্থ সুস্পষ্ট নয়। কোনো এজেন্সিকে সাইবার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষমতা দেওয়া হলেও সুস্পষ্ট কার্যকর ধারণার অভাবে এর অপব্যবহার বা উদ্দেশ্যবহির্ভূত ব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে

. সেবা প্রদানকারী কোনো তৃতীয় পক্ষের দায়মুক্তি

‘বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬’ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) অথবা নেটওয়ার্ক সেবা প্রদানকারী মধ্যবর্তী সংস্থাগুলোকে সব ধরনের দায় থেকে মুক্তি দিয়েছে। আইনে বলা হয়েছে: তাদের সেবা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ করা হলে তারা দায়ী হবে না। এই দায়মুক্তি পাওয়া যাবে তখনই, যখন তারা এটা প্রমাণ করতে পারবে যে, এই অপরাধ তাদের অজ্ঞাতসারে হয়েছে অথবা এ অপরাধ হতে না-দিতে সংস্থা যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েছিল। যদিও আইএসপিগুলোকে এ ধরনের দায়মুক্তি দিলে কারিগরিভাবে সত্যিকারের সাইবার অপরাধীকে খুঁজে বের করা সহজ হয়; কিন্তু সন্দেহ দূর করার জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৭৯ ধারায় বলা হচ্ছে: ‘নেটওয়ার্ক সেবা প্রদানকারী কোনো তৃতীয় পক্ষ তথ্য বা উপাত্ত প্রাপ্তিসাধ্য করিবার জন্য এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি বা প্রবিধানের অধীন দায়ী হইবেন না, যদি প্রমাণ করা যায় যে, সংশ্লিষ্ট অপরাধ বা লঙ্ঘন তাহার অজ্ঞাতসারে ঘটিয়াছে বা উক্ত অপরাধ যাহাতে সংঘটিত না-হয় তজ্জন্য তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করিয়াছেন।’ একইভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীন ধারা ৩৮ বলছে: ‘তথ্য-উপাত্ত প্রাপ্তির বন্দোবস্ত করিবার কারণে কোনো সেবা প্রদানকারী এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধির অধীন দায়ী হইবেন না, যদি তিনি প্রমাণ করিতে সক্ষম হন যে, সংশ্লিষ্ট অপরাধ বা লঙ্ঘন তাহার অজ্ঞাতসারে ঘটিয়াছে বা উক্ত অপরাধ যাহাতে সংঘটিত না-হয় তজ্জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছেন।’ স্মরণ রাখা দরকার, এই আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে: আইনের অধীন দায়িত্ব পালনকালে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত কোনো কার্যের ফলে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হইলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হইবার সম্ভাবনা থাকিলে, তজ্জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মচারী বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাইবে না।

এখানে মনে রাখা দরকার, এসব সেবা প্রদানকারী সংস্থা সাধারণত কোম্পানি হয়ে থাকে এবং এ সংক্রান্ত জাতিসংঘের ‘ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা ও ইন্টারনেট প্রতিবেদনের অনুচ্ছেদ ৭৬’ সুপারিশ করেছে যে, রাষ্ট্র যখন মানবাধিকারের প্রধান দায়িত্ববহনকারী, তখনও কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব রয়েছে মানবাধিকারকে শ্রদ্ধা করার।

ইন্টারনেট সেবা সরবরাহকারীরা বাংলাদেশে নিয়মিতভাবে নানা বিষয়বস্তু ইন্টারনেট থেকে সরিয়ে ফেলা ও ফিল্টার করার ‘অনুরোধ’ পান (ফ্রিডম অন দ্য নেট প্রতিবেদন-২০১৯)। এছাড়া প্রতিমাসেই তাদের বিটিআরসির কাছে ট্রাফিক ও ব্যবহারকারীদের বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে হয়, যা অনলাইনে ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি স্পষ্টতই হুমকি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের করা এসব ‘অনুরোধ’ (আদেশ) কোনো ধরনের আইনগত এখতিয়ারের মধ্য থেকে করা হয় না, যা স্পষ্টতই বে-আইনি। অনলাইনে ভাব এবং মতামত প্রকাশে বাধা প্রদানের জন্য অনেক সময় সেবা প্রদানকারীকে নানা বাধা-বিপত্তির পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দেখা যায় এবং বিচারিক হস্তক্ষেপের ব্যত্যয় করে মধ্যবর্তী সেবা সংস্থাগুলোকে মানবাধিকার হরণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। একইসঙ্গে স্মরণ রাখা ভালো, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কোনো স্থানীয় মধ্যবর্তী কোম্পানি কোনো ধরনের স্বচ্ছতার প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি, যা অনলাইনে ভাব প্রকাশের স্বাধীনতাসহ অন্যান্য মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দিতে পারে। অন্যদিকে গুগল এবং ফেসবুক কর্তৃক স্বচ্ছতার প্রতিবেদন এখনো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

. অস্পষ্ট অপরাধের অভিপ্রায়, স্থূল অপরাধীকরণ এবং মৌলিক মানবাধিকার সীমিতকরণ

এ আইন অনেকগুলো ধারায় অনেকগুলো অপরাধ অ-জামিনযোগ্য করে রেখেছে, যা আসলে স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন করে এবং একইসঙ্গে নির্দোষতার পূর্বানুমানকেও ক্ষুণ্ন করতে পারে, যা আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী অভিযুক্তের অধিকারের বরখেলাপ। এই আইনের ধারা ৫৩(ক) বলছে: ধারা ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪-এ উল্লিখিত অপরাধসমূহ আমলযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য হইবে; এবং ৫৩(খ) ধারা ১৮-এর উপধারা (১)-এর দফা (খ), ২০, ২৫, ২৯ ও ৪৭-এর উপধারা (৩)-এ উল্লিখিত অপরাধসমূহ অ-আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য হইবে।

নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত চুক্তির ৯ অনুচ্ছেদে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সুরক্ষার অধিকার রক্ষা করা হয়েছে এবং এই বিধান রয়েছে যে, ‘এটি সাধারণ নিয়ম হবে না যে, বিচারের অপেক্ষায় থাকা ব্যক্তিদের হেফাজতে রাখা হবে। একইসঙ্গে উদ্বেগের বিষয় যে, আন্তর্জাতিক আইন ও মানদণ্ডের অধীন, রাষ্ট্র কেবল বিচার মুলতুবি থাকা ব্যক্তিকে আটক করতে পারে, যেখানে বিচার বা প্রমাণ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অভিযুক্তের উপস্থিতি নিশ্চিত করা প্রয়োজনীয়।’ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত চুক্তির অনুচ্ছেদ ৯(৩) অনুযায়ী বিচার-পূর্ব আটক রাখা অনুমোদিত, তবে তা সীমিত পরিস্থিতিতে প্রদান করা হয়ে থাকে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটির মতে, ৯(৩) অনুচ্ছেদে এর প্রয়োজন রয়েছে, তবে অভিযুক্ত আসামি পলাতক বা মামলার প্রমাণ নষ্ট করেন, কিংবা সাক্ষীদের প্রভাবিত করতে পারেন বা রাষ্ট্রপক্ষের এখতিয়ার থেকে পালিয়ে যেতে পারেন, সেসব পরিস্থিতি বাদে, বিচারের আগে আটকের ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম হওয়া উচিত এবং জামিনও মঞ্জুর করা উচিত।

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, দীর্ঘ সময় ধরে বিচার-পূর্ব আটকে রাখার কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নির্যাতন ও অন্যান্য ধরনের নির্মম এবং অবমাননাকর আচরণের ঝুঁকিতে থাকতে হয়। বিগত সময়কালে মানবাধিকার সংগঠনগুলো নথিভুক্ত করেছে যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিচার-পূর্ব আটকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতন এবং অন্যান্য নির্যাতন, বিশেষত ‘রিমান্ড মানেই নির্যাতন’ এমন ধারণা পর্যন্ত রয়েছে। সুতরাং, সব রাষ্ট্রকে তার ফৌজদারি অপরাধ এবং কার্যবিধির আইনসমূহ, আইনের সাধারণ নীতিমালার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের দ্বারা স্বীকৃত এবং নির্ধারিত হতে হবে।

ধারা ১৮(১) বলছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে বে-আইনি প্রবেশ করেন বা প্রবেশ করিতে সহায়তা করেন বা অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে বে-আইনি প্রবেশ করেন বা প্রবেশ করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’ অর্থাৎ, কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেমে বা ডিজিটাল ডিভাইস বা সিস্টেমে অবৈধভাবে বা কর্তৃত্বহীনভাবে প্রবেশকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই বিধানও জোহানেসবার্গ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। জোহানেসবার্গ প্রিন্সিপল অনুসারে সংঘটিত অপরাধের চেয়ে জনস্বার্থ অধিক মূল্যবান হলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে না। অথচ এই ধারামতে, কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো তথ্য বা উপাত্ত জানার বা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে কোনো কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেমে বা ডিজিটাল ডিভাইস বা সিস্টেমে অবৈধভাবে বা কর্তৃত্বহীনভাবে প্রবেশ করে, যা জনস্বার্থে এই অপরাধের চেয়ে অধিক মূল্যবান, তাহলেও তিনি অপরাধী হিসেবে বিবেচ্য হবেন। এতে সরকারের বা সরকারের কোনো অংশের অপরাধ, দুর্নীতি বা অসদাচরণ জানার ও প্রকাশ করার ক্ষেত্র নিরুৎসাহিত হবে।

আবার আইনের ৩৫ ধারায় বলা হয়েছে: ‘কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধে সহায়তা করলে তিনিও অপরাধী হিসেবে বিবেচ্য হবেন ও মূল অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ড ভোগ করবেন।’ এখানে ‘অসৎ উদ্দেশ্য’ ও ‘জেনে-বুঝে’ সহায়তা করার কথা উল্লেখ না-থাকায় কোনো ব্যক্তি অপরাধকারীর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অজ্ঞাত থেকে বা নিজে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছাড়াই কাউকে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ করতে সহায়তা করলে তিনিও অপরাধী হিসেবে বিবেচ্য হবেন। এক্ষেত্রে অনেকেই এই আইনের অন্যায় শিকার হতে পারেন। যেমন, কোনো অপরাধকারীর সম্বন্ধে অজ্ঞাত থেকে বা তার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অজ্ঞাত থেকে কোনো ব্যক্তি তাকে কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক সুবিধা প্রদান করলে তিনিও এই আইনের অধীন অপরাধী হিসেবে বিবেচ্য হবেন ও দণ্ডপ্রাপ্ত হবেন। একইসঙ্গে, আইনের ৩৬ ধারায় কোম্পানি কর্তৃক কোনো অপরাধবিষয়ক বিধান রাখা হয়েছে। এতে ‘কোনো কোম্পানি কর্তৃক অপরাধ সংঘটিত হলে ওই অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির প্রত্যেক মালিক, প্রধান নির্বাহী, পরিচালক, ম্যানেজার বা অন্য কোনো কর্মকর্তাও অপরাধী হিসেবে বিবেচ্য হবেন যদি-না প্রমাণ করতে পারেন অপরাধটি তার অজ্ঞাতসারে হয়েছে বা তিনি অপরাধ রোধ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।’ এখানে প্রমাণের দায়ভার অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর রাখা হয়েছে, যেটা প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি। একদিকে যেমন এই অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন বা এই অপরাধের কোনো অর্থনৈতিক বা অন্য কোনো সুফল ভোগ করেননি বা এই অপরাধ সংঘটনে যার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না বা এই অপরাধ সংঘটন রোধ করা যার পক্ষে সম্ভব নয়, এমন ব্যক্তিও এ আইনের অন্যায় শিকার হবেন।

আইনের ২১ ধারায় বলা হয়েছে: ‘মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা বা প্রচারণা করিলে তিনি অনধিক ১০ (দশ) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১ (এক) কোটি টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’

  • প্রথমত, যেহেতু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো একক ব্যাখ্যা বা ব্যাখ্যাদানকারী কর্তৃপক্ষ নেই, সেহেতু সরকারের সঙ্গে ভিন্ন ব্যাখ্যা ধারণকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ এই আইনে অপরাধী বা অপকৌশলের শিকার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কিত ভিন্ন ব্যাখ্যা ধারণকারীরাই সব থেকে বেশি এই আইনের শিকার হবেন।
  • দ্বিতীয়ত, কোনো গোষ্ঠীর ব্যাখ্যা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো একক ব্যাখ্যা নির্ধারণ করাও অনৈতিক অবস্থান। উপরন্তু ইতিহাস আদালত কর্তৃক নির্ধারিত হওয়ার কোনো বিষয় নয়। গবেষকদের অনুসন্ধান ও গবেষণাই ইতিহাসের ব্যাখ্যা তৈরি করে। আদালত কর্তৃক ইতিহাসকে নির্ধারণ করে দেওয়া হলে একদিকে যেমন কোনো স্বাধীন গবেষক ইতিহাস নিয়ে অনুসন্ধান বা গবেষণা করতে নিরুৎসাহিত হবেন এবং তিনি যদি ইতিহাসের কোনো উপাদান নিয়ে গবেষণা করেনও এবং এমন কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করান যা সরকারের বা কোনো গোষ্ঠীর বিপরীতে যায়, তবে তিনি এই আইনের দ্বারা অপরাধী হিসেবে বিবেচ্য হতে পারেন।
  • তৃতীয়ত, এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২১ কিংবা অন্য কোনো ধারায় কী পরিমাণ প্রচারণায় যুক্ত হলে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, তা বলা হয়নি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা অত্যধিক বিস্তৃত এবং ইতিহাসের ব্যাপকতাও অনেক। আদালত কর্তৃক ইতিহাস নির্ধারণ করে দেওয়ার ফলে ইতিহাসের নানান উপাদান ও তাদের ব্যাখ্যার ব্যাপ্তিও সংকুচিত হবে। তদুপরি, আইসিসিপিআর-এর ১৯(৩) অনুচ্ছেদে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেসব বিবেচনায় সীমিত করার কথা উল্লেখ আছে, সেসবের মধ্যেও এই বিধান পড়ে না। জাতির পিতার বিরুদ্ধে যেকোনো প্রপাগান্ডা, প্রচারণা বা তাতে মদত দেওয়াকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হলে তা আদতে ব্লাসফেমি আইনসদৃশ হয়েযায়, যা কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে নিজস্ব বিশ্বাস ধারণ করতে নিরুৎসাহিত ও বাধা প্রদান করবে। তাই এ আইনের দ্বারা নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এই ধারাটি এমনভাবে অপরাধীকরণ করা হয়েছে যার শর্তসমূহ বিস্তৃত। এর উদ্দেশ্য এমন যে, এটি দেশের ইতিহাস এবং জাতির পিতার ভূমিকাসহ জনস্বার্থের বিষয়ে বৈধ বিতর্ককে বাধা দিতে পারে। এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বেমানান।

অন্যদিকে ধারা ২৫ বলছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যাহা আক্রমণাত্মক বা ভীতিপ্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করিবার বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার বা তদুদ্দেশ্যে, অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ। প্রথমবারের মতো অপরাধ করলে তিনি অনধিক ৩ (তিন) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৩ (তিন) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’

আবার ধারা ৩১ বলছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যাহা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটিবার উপক্রম হয়, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ এবং অপরাধের জন্য তিনি অনধিক ৭ (সাত) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন কিংবা অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১০ (দশ) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’

একইসঙ্গে, ধারা ২৫ এবং ৩১-এ অত্যধিক বিস্তৃত শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক মানগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমরা যদি ধারা ৩১-এর দিকে নজর রাখি তবে দেখব যে, ধারা ২৫-এর মূল শর্তগুলো অনির্ধারিত, যেমন: ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ বা ‘আইন শৃঙ্খলা’ বা ‘প্রতিকূলতা’। সহিংসতা বা বৈরিতা হওয়ার সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্ত সম্পর্কে বিধানটি আরও অস্পষ্ট। এটি আন্তর্জাতিক নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকারের চুক্তি সংক্রান্ত দলিলের ২০(২) অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে কিছু দলকে সহিংসতা বা বৈষম্য প্ররোচনা থেকে সুরক্ষার বিষয়ে উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, এই বিধানটি সাংবাদিক, মানবাধিকার রক্ষাকারী এবং অন্যান্য প্রকাশনা সম্পর্কিত মতবিরোধ বা সরকারের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির বিচার করতে সহজেই ব্যবহৃত হতে পারে। ধারা ৩৫ বলছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ এবং অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করিবার ক্ষেত্রে, মূল অপরাধটির জন্য যে দণ্ড নির্ধারিত রহিয়াছে, কোনো ব্যক্তি সেই দণ্ডেই দণ্ডিত হইবেন।’ ধারাটি কোন অপরাধকে সংঘটনের ক্ষেত্রে কিংবা কোন পদক্ষেপটি ‘সহায়তা’ হিসেবে গণ্য হতে পারে, তা সংজ্ঞায়িত করে না।

ধারা ৩১(১) বলছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যাহা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটিবার উপক্রম হয়, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ। উপধারা ২ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১)-এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৭ (সাত) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং উপধারা ৩ বলছে: যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১)-এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১০ (দশ) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’

২১, ২৫ ৩১এর মতো ধারা ৩৫ অত্যধিক বিস্তৃত এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অপরাধীকরণ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই বিধানগুলো সাংবাদিক, মানবাধিকার রক্ষাকারী এবং অন্যান্য প্রকাশনা শিল্প সম্পর্কিত যারা সরকারের কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা এবং সমালোচনামূলক মতামত প্রদানের সঙ্গে যুক্ত, তাদেরকে আইনি নিগ্রহ করতে সহজেই ব্যবহার করা যেতে পারে

অধিকন্তু, ৩৫ ধারাটি এই জাতীয় কোনো অপরাধ সংঘটনের উপাদান হিসেবে অভিপ্রায়কে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ। এই হিসাবে আমরা বিশ্বাস করি, ২১, ২৫ ও ৩১-এর মতো ধারা ৩৫-ও অত্যধিক বিস্তৃত এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অপরাধীকরণ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই বিধানগুলো সাংবাদিক, মানবাধিকার রক্ষাকারী এবং অন্যান্য প্রকাশনা শিল্প সম্পর্কিত যারা সরকারের কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা এবং সমালোচনামূলক মতামত প্রদানের সঙ্গে যুক্ত, তাদেরকে আইনি নিগ্রহ করতে সহজেই ব্যবহার করা যেতে পারে।

ধারা ৩২ বলছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি Official Secrets Act, 1923 (Act No. XIX of 1923)-এর আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১৪ (চৌদ্দ) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ২৫ (পঁচিশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং যদি কোনো ব্যক্তি উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা অনধিক ১ (এক) কোটি টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ কোনো ব্যক্তি যদি অন্য কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত পরিসরে তার দ্বারা সংঘটিত কোনো অপরাধ ধারণ করে বা তা প্রকাশ করে, তবে তা-ও এই বিধানে অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও এই বিধান শুধু দৃশ্য ধারণ করাকেই অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে না; বরং প্রকাশকেও অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করায় এমন কোনো দৃশ্য কোনো সংবাদকর্মী বা মাধ্যম প্রকাশ করলে তা-ও অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে। এক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম বা কর্মীরা সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতা রক্ষা করে, কারো ব্যক্তিগত পরিসরে সংঘটিত অপরাধের দৃশ্য প্রকাশ করার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হবেন। একইসঙ্গে কোনো সংবাদকর্মী বা মাধ্যম এমন ছবি প্রকাশ করলে অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত হবেন। অথচ কোনো ব্যক্তি যদি অন্য কোনো ব্যক্তির সম্মতিসাপেক্ষে তাঁর গোপনীয় দৃশ্য ধারণ করে; কিন্তু ওই ব্যক্তির সম্মতি ব্যতিরেকেই বা ওই ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেইল বা অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে ওই দৃশ্য কোনো অনলাইন নেটওয়ার্কে প্রকাশ করে, তবে তাকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। বর্তমানে এই ধরনের প্রবণতা অনেক বেশি লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে এটা নারী ও শিশুদের নির্যাতনের একটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তাই এর সুস্পষ্ট উল্লেখ না-থাকায় কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে গোপনীয় দৃশ্য ধারণ করার সম্মতি দিলেও তার অনুমতি ব্যতিরেকে বা তাকে না-জানিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি ওই দৃশ্য অন্য কোনো উপায়ে ধারণ বা প্রকাশ করলে তিনি সম্মতির অজুহাতে আইনের বাইরে চলে যেতে পারেন।

অথচ কোনো ব্যক্তি যদি অন্য কোনো ব্যক্তির সম্মতিসাপেক্ষে তাঁর গোপনীয় দৃশ্য ধারণ করে; কিন্তু ওই ব্যক্তির সম্মতি ব্যতিরেকেই বা ওই ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেইল বা অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে ওই দৃশ্য কোনো অনলাইন নেটওয়ার্কে প্রকাশ করে, তবে তাকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। বর্তমানে এই ধরনের প্রবণতা অনেক বেশি লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে এটা নারী শিশুদের নির্যাতনের একটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে

অন্যদিকে, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১-এর ৪ ধারায় বলা আছে: ‘কোনো তথ্য প্রকাশকারী উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট, যুক্তিযুক্ত বিবেচনায়, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্য প্রকাশ করিতে পারিবেন।’ আর ৫ ধারায় বলা আছে: জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্য প্রকাশকারীকে ফৌজদারি, দেওয়ানি মামলা বা বিভাগীয় মামলা, পদাবনতি, হয়রানিমূলক বদলি বা বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান, অন্য কোনো প্রকার বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও বৈষম্যমূলক আচরণ ইত্যাদির শিকার করা যাবে না এবং তথ্য প্রদানকারীর পরিচয় গোপন রাখতে হবে। আলোচ্য আইনের ধারা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উপরোক্ত সিদ্ধান্তসমূহের প্রতিটি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন-২০১১-এর সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং এই আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধও।

জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্য প্রকাশ এবং প্রকাশকারীকে তাঁর মতপ্রকাশের অধিকারের সুরক্ষা জলাঞ্জলি দিয়ে সরকারি গোপনীয়তা রক্ষা করা উচিত নয়। বিশেষত, এক্ষেত্রের যেকোনো আইন গঠনের সুযোগটি এত বিস্তৃত হওয়া উচিত নয় যে, সাংবাদিকতা, একাডেমিক গবেষণা এবং অন্যান্য বৈধ ক্রিয়াকলাপগুলোর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। তবে একইসঙ্গে মনে রাখা দরকার, এই একই আইনের ধারা ১০-এ মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করার দণ্ডের কথা বলা হয়েছে। ধারা ১০ বলছে: ‘মিথ্যা জানিয়া বা তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত না-হইয়া কোনো তথ্য প্রকাশকারী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো ভিত্তিহীন তথ্য প্রকাশ করিলে, যাহা জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য নহে বা যে তথ্যের ভিত্তিতে এই আইনের অধীন তদন্ত বা বিচারকার্য পরিচালিত হইবার সম্ভাবনা থাকে, তিনি মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে। কোনো তথ্য প্রকাশকারী কোনো মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করিলে তিনি এই আইনের অধীন অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য তিনি অন্যূন ২ (দুই) বৎসর বা অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং তথ্য প্রকাশকারী কোনো সরকারি কর্মকর্তা হইলে এবং তিনি কোনো মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করিলে তাহার বিরুদ্ধে উল্লিখিত দণ্ড ছাড়াও বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে।’

ধারা ২৮ (১) বলা হয়েছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করিবার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যাহা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ। উপরোক্ত ধারায় অপরাধ সংঘটন করলে, তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করে থাকলে তিনি অনধিক ১০ (দশ) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ২০ (বিশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’

এই ধারার ১ নম্বর উপধারায় অপরাধের সংজ্ঞায়ন ঠিক করে করা হয়নি, এখানে অপরাধের সংজ্ঞায়ন এমনভাবে করা হয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতা ধারণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আবার ধর্মীয় কুসংস্কার বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে বা ধর্মের পর্যালোচনা বা সমালোচনা নিয়ে যারা বিভিন্ন অনলাইন নেটওয়ার্কে মতামত প্রকাশ করেন তাঁদের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে। কোনো একক ব্যক্তির ধর্মীয় অনুভূতি রক্ষা করা আর পাবলিক অর্ডার বা মোরাল রক্ষা করা এক ব্যাপার নয়। আন্তর্জাতিক নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত চুক্তিতে ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কিত ১৮ নম্বর ধারার ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে এর ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। তাই একদিকে যেমন কারো ধর্মীয় এবং বিশ্বাসের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে, অন্যদিকে কারো ধর্মীয় ভিন্ন অবস্থান, বিশ্বাস বা ধর্মের পর্যালোচনা করার অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে ধর্মকেন্দ্রিক ঘৃণা প্রতিরোধ করার দায়িত্বও পালন করতে হবে। তাই অপরাধের এমন সংজ্ঞায়ন যারা ধর্মের মূলধারার ভিন্ন কোনো অবস্থান বা বিশ্বাস ধারণ করেন বা যারা ধর্মীয় বা বিশ্বাস বিষয় নিয়ে মতামত প্রকাশ করেন তাঁদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

একদিকে যেমন কারো ধর্মীয় এবং বিশ্বাসের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে, অন্যদিকে কারো ধর্মীয় ভিন্ন অবস্থান, বিশ্বাস বা ধর্মের পর্যালোচনা করার অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে ধর্মকেন্দ্রিক ঘৃণা প্রতিরোধ করার দায়িত্বও পালন করতে হবে। তাই অপরাধের এমন সংজ্ঞায়ন যারা ধর্মের মূলধারার ভিন্ন কোনো অবস্থান বা বিশ্বাস ধারণ করেন বা যারা ধর্মীয় বা বিশ্বাস বিষয় নিয়ে মতামত প্রকাশ করেন তাঁদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘মানহানি’ সংক্রান্ত আটক এবং গ্রেফতারের ঘটনাসমূহ মূলত ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু সব ফৌজদারি মানহানির আইন বাতিল এবং প্রতিস্থাপন করা উচিত। কেননা, এটি শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এগুলো রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অপরাধ এবং শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রেও অনলাইন এবং অফলাইনে ব্যাপক অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়। ধারা ২৯(১)-এ বলা হয়েছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে Penal Code (Act XLV of 1860)-এর ধারা ৪৯৯-এ বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তজ্জন্য তিনি অনধিক ৩ (তিন) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন’ এবং এই ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১)-এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ এখানে উল্লেখ্য, দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় মানহানি কীসে হবে আর কীসে হবে না, তা বলে দেওয়া হয়েছে এবং দণ্ডবিধির ৫০০ ধারায় মানহানির শাস্তি বর্ণনায় বলা হয়েছে: এই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে দুই বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয়বিধ দণ্ড হতে পারে।

৫০১ ও ৫০২ ধারা অনুসারে, মানহানিকর বলে পরিচিত বিষয় মুদ্রণ বা খোদাইকরণ সম্পর্কে এবং এর শাস্তি বর্ণিত হয়েছে। তাহলে উপরের দুটি আইনের ধারাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখতে পাচ্ছি যে, অনলাইন এবং অফলাইনে অপরাধের ভিন্ন ভিন্ন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে আনুপাতিকতা আন্তর্জাতিক আইনের একটি মূলনীতি। প্রত্যেক রাষ্ট্রকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, আইন দ্বারা আরোপিত জরিমানা এবং শাস্তি, বিশেষত যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বঞ্চনার সঙ্গে জড়িত, প্রশ্নযুক্ত অপরাধের সঙ্গে আনুপাতিক। জাতীয় সুরক্ষা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং তথ্যপ্রবাহ সংক্রান্ত জোহানেসবার্গের নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি, মিডিয়া আউটলেট, রাজনৈতিক বা অন্যান্য সংস্থা এই জাতীয় সুরক্ষা সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা ব্যবহার করে সংযম করা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা বা তথ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত সুরক্ষা সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য জরিমানা বা অপরাধীকরণ অস্বাভাবিক। একইভাবে, জাতীয় সুরক্ষা ও তথ্যের অধিকার সম্পর্কিত গ্লোবাল নীতিমালার (তসছ্বান নীনিমালা) ৪৬নং নীতিতে বিধান রয়েছে, জনসাধারণকে অননুমোদিতভাবে তথ্য প্রকাশের জন্য জরিমানা, ক্ষতির সঙ্গে সমানুপাতিক হওয়া উচিত।

ইমেইল বা অন্য পরিচালন মাধ্যমে মানহানি, দণ্ডবিধির ৫০০, ৫০১ ও ৫০২ ধারার অধীন দণ্ডযোগ্য অপরাধ, এক্ষেত্রে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় শাস্তির কথা বলা হয়েছে। মানহানি বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থায় দেওয়ানি ভুল অথবা ফৌজদারি অপরাধও হতে পারে; কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন একে কোনোভাবে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য করে না। বাংলাদেশের সংবিধানে যখন ‘যৌক্তিক বাধানিষেধ সাপেক্ষে’ ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের ঘোষণা দিচ্ছে, তখন ব্যক্তি, নাগরিক ও সংবাদমাধ্যমকে নানা জাতীয় নিরাপত্তা আইন, রাষ্ট্রদ্রোহ ও ফৌজদারি মানহানির অপরাধের মাধ্যমে স্বাধীন ভাব ও মতপ্রকাশ থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা করেছে, যা পরস্পর সাংঘর্ষিক। ২০০৯-এর ডিসেম্বরে মন্ত্রিসভা ফৌজদারি কার্যবিধির একটি সংশোধনী অনুমোদন দেয়, যেখানে কোনো লেখার ব্যাপারে মানহানির অভিযোগে মামলা করা হলে সম্পাদক, প্রকাশক, সাংবাদিক অথবা লেখককে গ্রেফতার করা যাবে না। কিন্তু এই সংস্কার প্রস্তাব এখনো চূড়ান্ত রূপ পায়নি–মানহানির অভিযোগে এখনো সাংবাদিকদের গ্রেফতার করতে দেখা যায়।

বাংলাদেশের সংবিধানে যখন যৌক্তিক বাধানিষেধ সাপেক্ষে ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের ঘোষণা দিচ্ছে, তখন ব্যক্তি, নাগরিক সংবাদমাধ্যমকে নানা জাতীয় নিরাপত্তা আইন, রাষ্ট্রদ্রোহ ফৌজদারি মানহানির অপরাধের মাধ্যমে স্বাধীন ভাব মতপ্রকাশ থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা করেছে, যা পরস্পর সাংঘর্ষিক

উপরোক্ত বিস্তৃত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সবশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাসহ বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া আছে। কিন্তু এই নিশ্চয়তা ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে’ মিলবে। বাস্তবে বাংলাদেশে সামরিক বা বেসামরিক, সব সরকারি সংস্থাই এই ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’-এর ব্যাখ্যা করে আসছে নিজেদের ইচ্ছেমতো সুবিধা অনুসারে। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ, আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং অনেক দেশের রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার আদালত এটা স্থির করেছে যে, ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর যেকোনো সীমাবদ্ধতা আরোপ অথবা বিষয়বস্তুভিত্তিক অথবা যোগাযোগের যেকোনো বৈদ্যুতিক ধরন অথবা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ভাবের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে গেলে তা অবশ্যই তিন ধাপের ধারাবাহিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এই তিন ধাপ হচ্ছে: তা অবশ্যই ক. আইনের মাধ্যমে হতে হবে, খ. একটি ন্যায্য লক্ষ্যে হতে হবে এবং গ. প্রয়োজনীয়তা ও সংগতিপূর্ণতা কঠোরভাবে বজায় থাকতে হবে। অতএব এই তিন ধাপের পরীক্ষা অনুসারেই অনলাইনে ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদি কোনো সীমাবদ্ধতা অনলাইনের ওপর আরোপ করা হয়, তবে সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে, যেন সেটি এসব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং আইন প্রণয়নের মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়।

কেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল প্রয়োজনীয়

১৯ জানুয়ারি ২০২০ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮-এর চারটি ধারা (২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারা) চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন আইনজীবী এবং শিক্ষকরা। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৫ ও ৩১ ধারা কেন অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন এবং আইন সচিব, তথ্য সচিবসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে (সমকাল, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০)। কিন্তু পাঁচ মাসের অধিক সময় চলে যাওয়ার পরও রুলের জবাব উচ্চ আদালতে এখনো দেওয়া হয়নি এবং করোনাকালে কবে দেওয়া হবে, তাও নাগরিকদের জানা নেই।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের আগে এবং পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী বলেছিলেন, আইনটি সাংবাদিক গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য নয়, মূলত অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য করা হয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত কমপক্ষে ১০০ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে প্রায় ৬০টি মামলায়। ১০০ জন অভিযুক্ত সাংবাদিকের মধ্যে কমপক্ষে ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে

মৌলিক মানবাধিকার হরণের বাস্তবতায় মূলত তিনটি কারণে এই আইনটি বাতিলের জোরদাবি নাগরিকরা জানাতে পারেন। প্রথমত, এই আইন প্রণয়নকালে আইনের খসড়া সম্পর্কে নাগরিকদের সঙ্গে প্রয়োজনীয়, অংশগ্রহণমূলক, পর্যাপ্ত এবং যথাযথভাবে আলাপ-আলোচনা করা হয়নি। নাগরিকরা তাঁদের নিজেদের উদ্যোগে এই আইনের খসড়া নিয়ে নানা ধরনের উদ্বেগজনক মতামত প্রদান করেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের আগে এবং পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী বলেছিলেন, এ আইনটি সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য নয়, মূলত অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য করা হয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত কমপক্ষে ১০০ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে প্রায় ৬০টি মামলায়। ১০০ জন অভিযুক্ত সাংবাদিকের মধ্যে কমপক্ষে ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়াও গ্রেফতার, আটক এবং কারাভোগ করেছেন শতাধিক নাগরিক। এসব মামলায় কতজন জামিন পেয়েছেন এবং কতজন এখনো জেলে রয়েছেন, তার সঠিক হিসাব জানা নেই।

দ্বিতীয়ত, এই আইনের প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ের প্রায় প্রতিটি ধারার সংজ্ঞায়ন থেকে শুরু করে বিবিধ অধ্যায়ের ক্ষমতা অর্পণ–জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতি, নৈতিকতা এবং মানদণ্ডের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং মানুষকে হয়রানির উদ্দেশ্যে সহজে ব্যবহার করা যায়। আইনটি ব্যবহার করে দায়ের করা প্রায় প্রতিটি মামলা গণমাধ্যমসহ নাগরিকদের চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করবে এবং যা ইতোমধ্যে কয়েকশ মামলার ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়েছে।

সাম্প্রতিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সীমাহীন দুর্নীতি, বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সুষম পরিকল্পনার অভাব, সুশাসনে সমন্বয়হীনতা, বিভ্রান্তিকর অবস্থান এবং দুর্নীতির সর্বজনীন রূপ সংক্রান্ত বিষয়ে জনগণের রয়েছে স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার। ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করায় সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে, যা খুবই আশঙ্কাজনক

তৃতীয়ত, সাম্প্রতিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সীমাহীন দুর্নীতি, বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সুষম পরিকল্পনার অভাব, সুশাসনে সমন্বয়হীনতা, বিভ্রান্তিকর অবস্থান এবং দুর্নীতির সর্বজনীন রূপ সংক্রান্ত বিষয়ে জনগণের রয়েছে স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার। ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করায় সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে, যা খুবই আশঙ্কাজনক। নাগরিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সুরক্ষা হরণের জন্য এই আইনকে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং নাগরিক অধিকার ও সাংবিধানিক সুরক্ষা লঙ্ঘন করা হচ্ছে।

উপরোক্ত আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, অনেকগুলো ধারায় নানা ধরনের সামরিকীকরণের চিহ্ন বা হয়রানিমূলক এবং নিবর্তনমূলক বাস্তবতা পরিলক্ষিত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় বিধি ও নীতিকে সহজেই হেয় প্রতিপন্ন করার সুযোগ তৈরি করবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সম্পূর্ণরূপে বাতিলযোগ্য। কারণ, এটি সংশোধনের অযোগ্য। একইসঙ্গে, বাতিল প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে উপযুক্ত ব্যক্তিবর্গ এবং নাগরিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিস্তর আলোচনা করতে হবে যাতে করে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় বিধিবিধান ও নীতিমালার মানদণ্ড প্রসারিত ও উপলব্ধি করা হয়, নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্র গোপনীয়তা রক্ষা করা যায় এবং সর্বোপরি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মহামারি মোকাবিলার অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে, বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে জামিনযোগ্য মামলায় অভিযুক্ত এবং নিপীড়নমূলক আইনের বলে আটক বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে এবং অচিরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো, সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা। মহামারি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সরকারের নীতি ও পদক্ষেপের ভুলভ্রান্তি তুলে ধরাসহ সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ মহামারি মোকাবিলার অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ দিক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মহামারি মোকাবিলার অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে, বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে জামিনযোগ্য মামলায় অভিযুক্ত এবং নিপীড়নমূলক আইনের বলে আটক ও বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে এবং অচিরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখাটি সর্বজনকথা ওয়েবসাইট থেকে নেয়া।